ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্যসেন

নতুন এক ইতিহাস সেদিন রচিত হয়েছিল দামপাড়া পুলিশ লাইনে। ব্রিটিশ সরকার সম্ভবত স্বপ্নেও কল্পনা করেনি এমন কোনো ঘটনার আঁচ। বাঙালী বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন

মাস্টারদা সুর্যসেন

১৮ এপ্রিল, ১৯৩০ সাল। রাত দশটা। চট্টগ্রামের সবকিছু চলছে ঠিকঠাক আর দশটা রাতের মতোই। অল্পবয়স্ক ছেলে ছোকড়ার দল খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে অধিকাংশই। যারা শোয়নি তারাও শোবার পায়তারা করছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে ঘরের বধুরা শুরু করেছে রাত্রি যাপনের প্রস্তুতি। নতুন বিয়ে হওয়া কোনো কোনো বধু হয়ত তেল মেখে ফিতেয় বাঁধছে অবাধ্য চুলগুলো। চারদিকে নেমে এসেছে জমাট অন্ধকার। রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা একেবারেই সীমিত। পাড়ার নেড়ি কুকুরগুলো এখানে ওখানে কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। হালকা ফিনফিনে বাতাস বইছে। ঘুমের দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করা চট্টগ্রামের মানুষজন তখনও জানে না, কি হতে চলেছে আজ। ব্রিটিশ সরকারের বুকের ওপর কী গভীর ক্ষত তৈরি হবে আজকেরই রাতে, তা তখনো কেউ টের পায়নি!

যারা টের পেয়েছে, তাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই আসল কাজে নেমে পড়বে তারা। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা, চারদিক পর্যবেক্ষণ শেষে চারটা বাড়ি থেকে বের হয়ে এল চারটা দল। লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট। কার কি করতে হবে পরিস্কার করে জানে সকলেই। নি:শব্দে তারা ছড়িয়ে গেল চারদিকে।

এই চারটা দল যখন ভিন্ন ভিন্ন পথে হারিয়ে গেল অন্ধকারে, ঠিক ততক্ষণে বহুদূরের ‘ধুম’ রেলস্টেশনে একটা মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে গেছে। এমনি এমনি উল্টে যায়নি। এদের দলেরই সতীর্থ একটা দল রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে নিয়েছিল সুযোগ বুঝে। মালগাড়িটা আসতেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল লাইন থেকে। এমনভাবে পড়ল যে গোটা চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল একেবারে!

ওদিকে আরো একটি দল চলে গেছিল টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসে। অতর্কিত আক্রমণ করে তারা টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস দখল করে নেয়। হাতুরি দিয়ে সব যন্ত্রপাতি ভেঙে দেয়। পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সেখানে। অকেজো হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা। রেলপথের পর তারালাপনী থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় চট্টগ্রাম!

লোকনাথ বলের নেতৃত্বে আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগারে আক্রমণ করে একই রাতে। খুব বেশি প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয় না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অস্ত্রাগারটি দখল করে নেয় বিপ্লবীরা। বিপুল পরিমাণ উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল দখল করে তারা। অস্ত্রগুলো গাড়িতে নিয়ে অস্ত্রাগারটিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে গোলাবারুদের অবস্থান র্নিণয় করতে ব্যর্থ হয় তারা। সেখানে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। এটা ছিল বিরাট হতাশার!

ত্রিমুখী আক্রমণ সফলতার সাথে শেষ করে সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী গনেশ ঘোষের নেতৃত্বে আক্রমণ করা হয় দামপাড়া পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক। ব্যারাকের অধিকাংশ পুলিশ তখন বিশ্রামে ছিল। অতর্কিত তাদের ওপর হামলে পড়ে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সদস্যরা। রিজার্ভ ব্যারাকের পুলিশ সদস্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ ব্যারাকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বিপ্লবীরা।

এদিন আরো একটি কাজ তারা করে ফেলে। যার জন্য প্রস্তুতি হয়ত সেভাবে ছিল না। ঝোঁকের বসে এই আক্রমণে অংশ নেওয়া বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে বসে। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্যসেনকে সংবর্ধনা দেয় তারা। সূর্যসেন চট্টগ্রামে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। তার ঘোষণায় তিনি বলেন,

“The great task of revolution in India has fallen on the Indian Republican Army. We in Chittagong have the honour to achieve this patriotic task of revolution for fulfilling the aspiration and urge of our nation. It is a matter of great glory that today our forces have seized the strongholds of Government in Chittagong…The oppressive foreign government has closed to exist. The national Flag is flying high. It is our duty to defend it with our life and blood.”

নতুন এক ইতিহাস সেদিন রচিত হয়েছিল দামপাড়া পুলিশ লাইনে। ব্রিটিশ সরকার সম্ভবত স্বপ্নেও কল্পনা করেনি এমন কোনো ঘটনার আঁচ। 
বাঙালী স্বদেশী বিপ্লবীরা সূর্যসেনের নেতৃত্বে এমনই এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল যে গোটা ব্রিটিশ সম্রাজ্যজুড়ে হৈ চৈ পড়ে গেল! চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন।

ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ, সাল ১৯৩৩। রাতের বেলা এ বাড়িতে এক বৈঠকে মিলিত হলেন সূর্যসেন। সাথে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। গোপন মিটিং চলছে। এদিকে সূর্যসেনের মাথার দাম তখন দশ হাজার টাকা। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্রসেন সে টাকার লোভ সামলে উঠতে পারল না। সে সংবাদ পৌছে দিল পুলিশকে। রাত প্রায় দশটার দিকে পুলিশ আর সেনা সদস্যদের যৌথ বাহিনী ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের এই বাড়িটি ঘিরে ফেলল চারদিক থেকে। শুরু হল গোলাগুলি।

হাত বোমা ফাটিয়ে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত আর সুশীল দাসগুপ্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু পারলেন না মাস্টার দা। অন্ধকারে গুলি করতে করতে তিনি এসে পড়ে গেলেন বাঁশঝাড়ের পাশে এই খাদটিতে। খাদের ভেতর ছিল শুকনো বাঁশ পাতার গাদা। এরই ভেতর ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলেন তিনি অনেকক্ষণ। চারিদিকে শত শত ইংরেজ সৈন্যর চোখ। কোনো অবস্থাতেই মাথা তোলবার উপায় নেই। ঘন্টা দুই তিনেক এভাবে প্রায় শ্বাস বন্ধ করে নিশ্চুপ পড়ে থেকে, অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। একটু নড়াচড়া করতেও পারছেন না। শুকনো পাতায় খসখস আওয়াজ হচ্ছে। রাত থাকতে থাকতে এখান থেকে সটকে পড়তে না পারলে ধরা পড়া বিনে গতি নাই। কাজেই রিস্ক তাকে নিতেই হল। কোনোরকমে মাথা উঁচু করে চারিদিকটা দেখতে চাইলেন। বিপত্তি ঘটাল শুকনো বাঁশপাতা। একটু নড়ে উঠতেই খসমসে আওয়াজ করে উঠল। পাশেই ছিল কয়েকজন ইংরেজ সৈন্য। লাফিয়ে পড়ে তারা ধরে ফেলল সূর্যসেনকে। সূর্যসেনের রিভলবার তখন ছিল গুলিশূন্য। একেই বলে ভাগ্য! নির্মম ভাগ্য! তিনি পারলেন না! ধরা পড়ে গেলেন! তার সাথে ধরা পড়লেন ব্রজেন সেন!

পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সূর্যসেন ও ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দফতরে, পরে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম জেলে। সূর্যসেন গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল,

“চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সম্পর্কে ফেরারী সূর্যসেনকে গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে প্রেফতার করা হইয়াছে। সূর্যসেনকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় প্রধান আসামি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। গত ১৯৩০ সাল হইতে সূর্যসেন পলাতক ছিলেন এবং তাহাকে ধরাইয়া দিবার জন্য গভর্নমেন্ট দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন।”

১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেঙ্গল চিফ সেক্রেটারি কর্তৃক লন্ডনে ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে পাঠানো রিপোর্টে লেখা হয়,

“The outstanding event of the fortnight is the arrest on 17 February of Surja Sen of Chittagong Armory Raid notoriety, who, as the leader and brain of absconders, has been giving constant anxiety over the last three years. It was unfortunate that when Surja sen and his companion were arrested, 4 others made good their escape…But luck enters very largely into these night operations and it certainly was a great stroke of luck that Surja Sen was secured.”

মাত্র কয়েক লাইনের এই মেসেজ থেকেই বোঝা যায় কি জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিলেন সূর্যসেন ইংরেজ সরকারের মনে। ঘুম হারাম করে দিয়েছিল একেবারে। সূর্যসেনকে গ্রেফতারের মাধ্যমে তার মনে যেন নেমে এল বিরাট স্বস্তি!

সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্তকে আসামি করে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ‘১২১/১২১ এ’ ধারা অনুযায়ী গঠন করা হয় স্পেশাল ট্রাইবুনাল। বাখরগঞ্জের দায়রা জজ ডব্লিউ ম্যাকসার্পি, সিলেটের অতিরিক্ত দায়রা জজ রজনী ঘোষ এবং চট্টগ্রামের দায়রা জজ খোন্দকার আলী তোয়েবকে যৌথ কমিশনার করা হয় এই ট্রাইবুনালের। কঠিন গোপনীয়তার ভেতর দিয়ে চলতে থাকে মামলার শুনানী। কেবল আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা ছাড়া সূর্যসেনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আর কোনো অভিযোগের প্রত্যক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়নি। তারপরও রায়ে ১২১ ধারা অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে প্রাণদন্ড দেওয়া হয় তাকে। প্রাণদন্ড দেওয়া হয় তারকেশ্বর দস্তিদারকেও। কল্পনা দত্তকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদন্ড! এ বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা পরের দিন লিখেছিল,

“চট্টগ্রাম ১৪ই আগস্ট- অদ্য দ্বিপ্রহর ১২ ঘটিকার সময় স্পেশাল ট্রাইবুনাল হইতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার রায় প্রদত্ত হয়। ট্রাইবুনাল সূর্যসেনকে ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করিয়া প্রাণদন্ডে দন্ডিত করে। ওই একই ধারায় তারকেশ্বর দস্তিদারের প্রতিও প্রাণদন্ডের আদেশ প্রদত্ত হয়। কুমারী কল্পনা দত্তকে ভারতীয় দন্ডবিধির ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করিয়া তাহার প্রতি যাবজ্জীবন দন্ডাদেশ প্রদান করা হয়। আদালত প্রাঙ্গনের চারিদিকে পুলিশের বিশেষ বন্দোবস্ত করা হইয়াছিল। রায় প্রদত্ত হইবার পূর্বে সেনাদল কিছুকাল শহরে কুচকাওয়াজ করে। আসামীরা শান্তচিত্তে দন্ডাদেশ গ্রহণ করে এবং তাৎক্ষণাৎ আদালত হইতে স্থানান্তরিত করা হয়। তাহারা বিপ্লবাত্মক ধ্বনি করিতে করিতে আদালত গৃহ ত্যাগ করে।”

জেলখানায় শুরু হয় সূর্যসেনের বন্দী জীবন। এবার কনডেম সেল! কড়া পাহারায় তাকে আটকে রাখা হয় নির্জন কুঠুরীতে। একাধিকবার তার সহযোগী বিপ্লবীরা জেলখানা থেকে তাকে মুক্ত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রতিবারই তাদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। সূর্যসেন বন্দী থাকেন জেলে। তবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার লোক তো তিনি না! কনডেম সেলে বন্দি থেকেও তিনি জেলখানায় বন্দী অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করেন। একজন কয়েদী মেথর সূর্যসেনের লেখা চিঠি ময়লার টুকরীতে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসত।

মৃত্যুর আগে আটক বিপ্লবী কালীকিংকর দে’র কাছে সূর্যসেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। সে বার্তায় তিনি লেখেন,

“আমার শেষ বাণী- আদর্শ ও একতা।”

তিনি স্বরণ করেন তার স্বপ্নের কথা। স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন যার জন্য জীবনভর উৎসাহ ভরে, অক্লান্তভাবে তিনি পাগলের মতো ছুটেছেন। তিনি লিখেছেন,

“ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।” তার সংগঠনে বিভেদ না আসার জন্য একান্ত ভাবে আবেদন করেন।

শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় তার একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছে হল। সেই সময় জেলের অন্য এক সেলে বন্দী ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। রাত ১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাকে চিৎকার করে ডাকেন,

“এই বিনোদ! বিনোদ! দরজার কাছে আয়। মাস্টার দা গান শুনতে চেয়েছেন!”

বিনোদ বিহারী গান জানতেন না। না জানলেই কী? মাস্টার দা শুনতে চেয়েছেন বলে কথা। তিনি তার জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন। সূর্যসেন চোখ বন্ধ করে স্থীর হয়ে শুনলেন গানটা! এরপর আর কখনো তিনি গান শোনেন নি!”

[‘জলপাই রঙের কোট’ উপন্যাস থেকে সংক্ষেপিত।']


লেখক: আরকে মৃদূল


Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.