হাইড্রোজেন পার অক্সাইড - আগুন নেভাতে পানি কার্যকরী

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড একটা অতি দাহ্য বিস্ফোরক।রকেটের জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এর আগুন নেভানোর জন্য পানি সর্বোত্তম

জাভেদ ইকবাল: 

সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে, অনেকে আহত, এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা যাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। শুরুতেই একটা কথা বলে নেই। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের আগুন নেভানোর জন্য পানিই সবচাইতে ভাল। যারা পানি ব্যবহারের সমালোচনা করছে, তারা কিছু না জেনেই ওস্তাদি ফলাচ্ছে। বিস্তারিত জানার জন্য লেখাটার শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড - আগুন নেভাতে পানি কার্যকরী


নাসা-র FIRMS (Fire Information for Resource Management System) মোট সাতটা স্যাটেলাইট থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মেপে কোথায় কত বড় আগুন ধরেছে সেটা ম্যাপে দেখায়।

https://firms.modaps.eosdis.nasa.gov/map/#t:adv;d:7days;l:noaa20-viirs,viirs,modis_a,modis_t,street;@91.8,22.5,12z

(লিংকে আজকে থেকে গত ৭ দিনের উপাত্ত দেখাবে, তাই জুন ১১ এর পরে এই লিংকে এই আগুন আর দেখা যাবে না। তখন তারিখ দিয়ে বের করা লাগবে।

ঐ ম্যাপ থেকে দেখছি, প্রায় ২.৭৪ বর্গ কিলোমিটারের কিছু কম এলাকা জুড়ে আগুন জ্বলেছে।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কী? 

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড একটা অতি দাহ্য বিস্ফোরক। এটা কিছু রকেটের জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

আগুন ধরা হচ্ছে কোন বস্তুর সাথে অক্সিজেনের খুব দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া করে সংযুক্ত হওয়া। লোহায় মরিচা ধরা সেই একই বিক্রিয়ার খুব ধীর একটা সংস্করণ। আর যদি সেটা অতি দ্রুত হয়, তাহলে ঘটে বিস্ফোরণ।

হাইড্রোজেন পারক্সাইডের রাসায়নিক ফর্মুলা হচ্ছে H2O2, পানির H2O। অর্থাৎ এটার প্রতি অণুতে পানির চাইতে একটা অক্সিজেন পরমাণু বাড়তি আছে। 

এই বাড়তি অক্সিজেনকে ধরে রাখা একটু কঠিন--সময়ের সাথে এটা ভেঙ্গে পানি ও একটা মুক্ত অক্সিজেন পরমাণু তৈরি করে। আর সেই মুক্ত অক্সিজেন সুযোগ পেলেই অন্য কিছুর সাথে বিক্রিয়া করার চেষ্টা করে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা হয় আরেকটা মুক্ত অক্সিজেন পরমাণুর সাথে, ফলে দুই পরমাণু বিশিষ্ট একটা অক্সিজেন অণু তৈরি হয়। সেটাও আগুনের সহায়ক, কিন্তু মুক্ত অক্সিজেন পরমাণুর মত আগ্রাসী না। এই ভেঙ্গে যাওয়া ও অক্সিজেন তৈরি হওয়া থেকে কীভাবে সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ধারনা করছি, সেটা একটু পরে বলছি।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কী কাজে লাগে?

চুল ব্লিচ করা হয় হাইড্রোজেন পারক্সাইড দিয়ে, সেটা ঘটে এই বাড়তি অক্সিজেনের কারনে। চুলের মেলানিনের ইলেকট্রন আকর্ষন করে নেয় এই অক্সিজেন, ফলে মেলানিন ভেঙ্গে যায়, চুল সাদা/সোনালী হয়ে যায় এই কারনে। দাঁতের হলুদ দাগ তোলার জন্যও হাইড্রোজেন পারক্সাইড ব্যবহার করা হয়। এক সময় কেটে গেলে সেখানেও হাইড্রোজেন পারক্সাইড ব্যবহার করা হতো, কারন একই ভাবে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের দেয়ালের ইলেকট্রন কেড়ে নিয়ে সেটাকে মেরে ফেলে/ভেঙ্গে দেয় হাইড্রোজেন পারক্সাইড। আলো পড়লে এই বিক্রিয়াগুলি আরো দ্রুত ঘটে, তাই দাত সাদা করার সময় হাইড্রোজেন পারক্সাইড জেল মাখিয়ে সেটায় আলো দেয়া হয়।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড - ঐতিহাসিক ঘটনা

১৯৫৫ তে ব্রিটিশ নেভি-র সাবমেরিন এইচ এম এস সিডন নিজের একটা টর্পেডো বিস্ফোরণে ডুবে যায়, কারন সেই টর্পেডোতে হাইড্রোজেন পারক্সাইড জ্বালানি ছিল। এর পর থেকে ব্রিটিশ নেভি হাইড্রোজেন পারক্সাইড জ্বালানী ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। ২০০০ সালে রাশান সাবমেরিন কুরস্ক ও হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরণে ডুবে যায়। (https://edu.rsc.org/download?ac=508333)। 

অর্থাৎ হাইড্রোজেন পারক্সাইড খুব আগ্রাসী একটা রাসায়নিক হতে পারে। ৪০% এর বেশি ঘনত্বের হাইড্রোজেন পারক্সাইড তাই বিপদজনক।

সীতাকুণ্ড বিএম ডিপোতে আগুন লাগলো কীভাবে?

Bdnews24.com (https://bdnews24.com/bangladesh/2022/06/05/a-bangladesh-depot-burnt-through-the-night.-did-a-chemical-keep-the-inferno-on) থেকে পাওয়া ছবিতে (২য় ও ৩য়) দেখা যাচ্ছে সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপো থেকে উদ্ধার করা হাইড্রোজেন পারক্সাইডের আঁধার। ৬০% ঘনত্ব লেখা লেবেলে। অর্থাৎ এই ঘনত্বের হাইড্রোজেন পারক্সাইড অতি সাবধানে রাখা উচিত। একটা আঁধার ফাটা দেখা যাচ্ছে—সেটা কীভাবে হয়েছে জানি না। তবে আমরা জানি যে সময়ের সাথে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ভেঙ্গে অক্সিজেন তৈরি হবে, এবং পাত্রে চাপ বাড়তে থাকবে। ফলে পাত্র ভেঙ্গে যাওয়া অসম্ভব না, অথবা লিক করে অক্সিজেন বের হওয়া সম্ভব। তারপর কী হয়েছে, সম্ভবত আমরা কখনো জানবো না। কেউ কি আশেপাশে সিগারেট ধরিয়েছিল? লাইটের সুইচ অন করেছিল, যাতে ইলেকট্রিকাল স্পার্ক হয়েছে এবং সেটা থেকে আগুনের সূত্রপাত? আমরা শুধু জানি, আগুনে দগ্ধ মানুষের সংখ্যা ১০০-র কাছাকাছি, মারা গিয়েছেন অনেকে, যাদের মধ্যে আছেন পুলিশ ও অগ্নি নির্বাপক সার্ভিসের কর্মী।

এই লিংক দুটোয় অ্যামেরিকা 

(https://www.fpl.fs.fed.us/documnts/pdf2010/fpl_2010_anderson001.pdf) ও অস্ট্রেলিয়ার 

(https://blog.storemasta.com.au/hydrogen-peroxide-storage-and-handling-requirements

হাইড্রোজেন পারক্সাইড নিরাপদভাবে মজুদ ও ব্যবহারের নীতিমালা দেয়া আছে।

অ্যামেরিকান নীতিমালা থেকে: 

“Hazard and Risk Assessment processes typically lead most industrial users to avoid storage at concentrations greater than 50%. Mills can receive hydrogen peroxide at 70% concentration, and dilute for storage at 50% concentration.”

অর্থাৎ কারখানাগুলি ৭০% ঘনত্ব পর্যন্ত পেতে পারে, কিন্তু নিজেদের ব্যবহারের জন্য মজুদ করার সময় সেটাকে কমিয়ে ৫০% এ নামিয়া আনা দরকার। যেহেতু এখানে রফতানির জন্য রাখা ছিল, তাই ৬০% ঘনত্ব ঠিক আছে।


একই নীতিমালার ৩য় পৃষ্ঠা থেকে, 

“The more common hazard is an “explosive” pressure rupture due to a gas generation rate exceeding the vent capacity of a container. Catalytic decomposition results in the liberation of oxygen and heat. One liter of 50% hydrogen peroxide yields approximately 200 liters of oxygen and additional volumes of steam.

 অর্থাৎ ১ লিটারের পাত্রে রাখলে যদি সেই হাইড্রোজেন পারক্সাইড ভাঙ্গতে থাকে, সেটা থেকে ২০০ লিটার অক্সিজেন বের হবে, অর্থাৎ সেটার জন্য হয় ২০০ গুন স্থান লাগবে, নয়তো সেই পাত্রের ভেতরে চাপ ২০০ গুন বেড়ে যাবে। সমস্যা হচ্ছে এখানেই--যদি পাত্রের কোন ত্রুটি থাকে, সেই চাপে পাত্রে ফাটল ধরবে, উপরে যেটাকে বলা হয়েছে “explosive” pressure rupture

হাইড্রোজেন পারক্সাইডের তাপমাত্রা সব সময় পর্যবেক্ষনে রাখা লাগে। যদি দেখা যায় যে সেটার তাপমাত্রা ঘন্টায় ১ থেকে ২ ডিগ্রি বাড়ছে, তাহলে ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সেটা বিপদজনক। তখন হয় তাপমাত্রা কমিয়ে বা পানি মিশিয়ে দ্রবণের ঘনত্ব কমিয়ে সেটাকে আবার স্থিতিশীল করা যায়। 

Hydrogen peroxide storage temperature should be monitored. The decomposition process is usually slow at first, and may take days or weeks to become ‘critical’. In case of extreme contamination in storage, the decomposition can reach dangerous proportions quickly. A temperature increase of 1-2°C per hour, at 30-35°C, is indicative of a decomposition event. Decomposition reactions in storage can be quenched by external cooling or dilution.


কন্টেইনার ডিপোর কর্মকর্তারা কি এগুলি জানতেন?


এ তো গেল তাত্বিক কচকচানি।

Joint Secretary Md Naid Ali, currently serving as the chief explosives inspector of the Directorate of Explosives, a wing under the Ministry of Power, Energy and Mineral Resources, said hydrogen peroxide is not registered as a combustible chemical agent by the directorate as of yet.

আসলেই? যে জিনিসের কারনে সাবমেরিন ধ্বংস হয়েছে, যা রকেটের জ্বালানী, যেটার পাত্রের গায়ে পরিষ্কার লেখা থাকে Heating may cause an explosion সেটা সরকারের তালিকায় নাই?

শেষ করি আরেকটা দুঃখজনক তথ্য দিয়ে। ফেইসবুকে অনেক বোদ্ধা পোস্ট করছেন, এই আগুনে পানি ব্যবহার করা উচিত হয় নাই। সেটা দেখে মাথা নেড়েছি। কিন্তু এই খবর দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। 

 Anisur Rahman, deputy director of the Chattogram division fire service, said the officials of the private depot have yet to confirm the types of chemical agents that were stored inside. The fire service applied water to douse the fire initially, as it does on most occasions, he said.

“We definitely would have adopted a different approach if we had been told about the presence of chemical agents in the depot,” Anisur said.

 হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বিষ্ফোরিত আগুন নেভানোর উপায়

হাইড্রোজেন পারক্সাইডের আগুন তেলের আগুন না, ইলেকট্রিকাল আগুন না। এটা নেভাতে পানিই ব্যবহার করা লাগে। ফোম অগ্নিনির্বাপক, যা তেলের আগুনে ব্যবহার করা যায়, সেটা এখানে কোন উপকার করবে না।

In case of fire, USE ONLY WATER. Deluge with large quantities. Foam is not effective because oxygen and heat continue to be generated under the foam blanket.

(https://www.fpl.fs.fed.us/documnts/pdf2010/fpl_2010_anderson001.pdf, পৃষ্ঠা ৪)

Flood with water to extinguish fire

(https://nj.gov/health/eoh/rtkweb/documents/fs/1015.pdf, পৃষ্ঠা ৩)

টিবিএস নিউজ ও সঠিক তথ্য দিচ্ছে

If the chemical is present in a fire explosion, flood with water to extinguish fire.

It is recommended not to use dry chemical extinguishing agents as poisonous gases are produced in fire.

(https://www.tbsnews.net/bangladesh/things-you-should-know-about-hydrogen-peroxide-caused-huge-blaze-ctg-container-depot)


গুরত্বপূর্ণ আপডেট: 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি রিসার্চারের লেখা বলে একটা কালেক্টেড পোস্ট ঘুরছে যেখানে বলা হয়েছে পানির অক্সিজেন থেকে আগুন আরো বাড়বে। পানি থেকে অক্সিজেন বের করা যায়, কিন্তু সেটার জন্য প্রচুর শক্তি লাগে আণবিক বন্ধন ভাঙ্গার জন্য, যেটা আগুন থেকে আসা সম্ভব না, সেটা যত বড় আগুনই হোক না কেন। আগুনে যদি সেই পরিমাণ শক্তি থাকে, তাহলে বন্ধন ভাঙ্গার আগেই পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে, এবং আগুনের তাপ কমাতে থাকবে। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড পানিকে ভাঙ্গতে পারে না। সুতরাং ঐ লেখায় ভূয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে]

আগুন জ্বালাতে  তিনটি জিনিস লাগে

উত্তাপ, জ্বালানী, অক্সিজেন। 

তিনটার যে কোন একটা বন্ধ করে ফেললে আগুন নিভে যায়। সাধারণ কেমিক্যাল আগুনে ফোম বা অন্য কেমিক্যাল যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে বাতাসের অক্সিজেনের পথ বন্ধ করা হয়, ফলে আগুন নিভে যায়। এখানে অক্সিজেনের সরবরাহ আসছে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থেকে, সুতরাং ফোম দিলে কোন লাভ হবে না। পানি দিলে দুইটা কাজ হবে—তাপমাত্রা কমতে থাকবে, এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের ঘনত্ব কমতে থাকবে, ফলে অক্সিজেনের সরবরাহ কমতে থাকবে। ফলে এক সময় আগুন নিভে যাবে।

ফায়ার সার্ভিস প্রথমে ঠিক কাজই করেছে, এবং নিজেরা প্রাণ দিয়ে লড়েছে। না জেনে কথা বলে আশাকরি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা নিজেদের কর্মীদের এই ত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। আর ফেইসবুক বোদ্ধাদের বলার কিছু নেই। 


লেখক: প্রকৌশলী (বুয়েট) 

ফেসবুক আইডি: www.Facebook.com/jikbal 

(লেখাটি লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া)


Hydrogen peroxide reaction with water,

hydrogen peroxide, 

 hydrogen peroxide fire, 

hydrogen peroxide formula, 

hydrogen peroxide history

Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.