ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া, স্মার্টফোন কি মানুষের স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে?

ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া , স্মার্টফোন কি মানুষের স্মৃতি শক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে? বিশেষজ্ঞদের মতে এটা কতোটা গুরুতর? শর্ট টার্ম মেমোরি লস থেকে মুক্তির উপায় কি

কি জানি বলছিলাম! উফ মনে পড়ছেনা। আমার কিছুই মনে থাকেনা। আজকালকার খুবই কমন অভিযোগ হলো, 'আমার কিছু মনে থাকেনা'। এর কারণ কী?  অতিরিক্ত স্মার্টফোনের ব্যবহার কি আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে? স্মার্টফোনের অবিরাম ব্যবহার আর নিয়মিত বিক্ষিপ্ততা কি আমাদের নতুন স্মৃতি তৈরিতে বাঁধাগ্রস্ত করছে? 

ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া, স্মার্টফোন কি মানুষের স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে?

গত সপ্তায় আমি একটি মিটিঙে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়েছি কারণ ফোনে রিমাইন্ডার সেট করতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু একই দিনের মিস মার্ভেল সিরিজে ওয়ালিদ চরিত্রে কে অভিনয় করেছে আমার স্পষ্ট মনে আছে। স্মৃতি খুবই অদ্ভুৎ, অপ্রত্যাশিত এবং অঅনুমানযোগ্য। নিউরোসাইন্স এখনো স্মৃতি ব্যাপারটাকে ভালোভাবে বুঝতে পারেনি। এইযে দ্রুত ভুলে যাওয়া রোগ, প্রথমেই এর জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করাটাই বরং স্বাভাবিক। আমাদের মায়েরা সচরাচর যা করে থাকেন আরকি। তবে এই দ্রুত ভুলে যাওয়া রোগের কারণ কি স্মার্টফোন বা প্রযুক্তি?

বর্তমানে অনেক কিছুই কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হয়না। ফোনের নোটপ্যাডটা খুলেই টুকে রাখি, এলার্ম সেট করে রাখি, রিমাইন্ডার অন করে রাখি। কিছু জানার হলে গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিন আর উইকিপিডিয়ার মতো বিশাল তথ্যভাণ্ডার আছে, মুহুর্তেই চাইলে জেনে নিতে পারি। কিন্তু এই স্মৃতি মাথায় ধরে রাখা বরং দূরহ ব্যাপার। মানুষ কি তাহলে মাথায় জ্ঞান সংরক্ষণ করা থামিয়ে দিচ্ছে?

মানুষের মস্তিষ্ক হলো একটি বিশাল উইকিপিডিয়ার মতো। যুগ যুগ ধরে যুগান্তরের ইতিহাস, জ্ঞান বিজ্ঞান, শাস্ত্র জ্ঞানীরা তাদের মস্তিষ্কে ধারণ করে এসেছে। বড় বড় গ্রন্থ, পুঁথি মানুষ মুখস্থ করে করে সেটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বিলিয়ে গেছে। তবে বর্তমান স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের কাছে এটা রূপকথা হতে চলেছে। মানুষের মস্তিষ্ক আর স্মার্টফোনের মধ্যে একটা মিথস্ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে ২০০০ এর পর থেকে সারা পৃথিবীতে ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েছে। তবে সাম্প্রতিক মহামারীকালে যেন এই স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাটা আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী চাপ, ক্লান্তি, বিচ্ছিন্নতা যেনো ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে স্বাভাবিক ঘটনা। সম্প্রতি ২০২১ এ ক্যাথরিন লাভডে'র গবেষণা অনুসারে ৮০ শতাংশ মানুষই মনে করছে তাদের স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে। খুবই ছোটখাটো থেকে গুরত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভুলে যাচ্ছে সহজেই। বিশেষজ্ঞরা এই সমস্যার নাম দিয়েছে ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া

ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া কি

ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া হলো এক প্রকার দ্রুত ভুলে যাওয়ার রোগ। প্রধানত প্রযুক্তির অতিব্যবহার, মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদির কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা বেশি দেখা যায়।

ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া কেন হয়

বিশেষজ্ঞদের মতে প্রযুক্তি তথা প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারই ডিজিটাল অ্যামনেশিয়ার প্রধাণ কারণ। এছাড়া মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন, নিদ্রাহীনতা এর সাথে যুক্ত হয়েছে। স্মার্টফোনের দীর্ঘ ব্যবহার মানুষকে নতুন কিছু শেখার প্রতি অনিহা জাঁগিয়ে দিচ্ছে। খুব ছোটখাটো বিষয় থেকে শুরু করে অনেক গুরত্বপূর্ণ বিষয়ও মানুষ ভুলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। মানুষ দীর্ঘক্ষণ স্মার্টফোনের বিক্ষিপ্ত ও বহুবিধ ব্যবহার করছে যার ফলে নিদ্রাহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। কমবয়সীরা স্মার্টফোনের কল্যানে অনেক রাত করে ঘুমায় কিংবা জেঁগেই রাত পার করে দেয়। গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো স্মৃতিগঠনের বেশিরভাগ কার্যসাধন হয় ঘুমের ভেতরেই। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে মস্তিষ্ক ঘটে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে নেয়। কিন্তু ঘুমই যদি না হয়  তবে মস্তিষ্ক তার কার্য সম্পাদনে ব্যহত হচ্ছে, স্মৃতিও তৈরি হচ্ছেনা। ফলস্বরূপ এই ভুলে যাওয়া রোগ কিংবা ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া'র উদ্ভব। 

বিশেষজ্ঞদের মতে ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া

বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এই বিষয়ে ভিন্ন মতও দেখা যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স এর অধ্যাপক ক্রিস বার্ড বলেছেন, "আমরা বরং ছোটখাটো বিষয়ে চিন্তা করার দায়িত্বটা এক্সটারনাল ডিভাইসের উপর ছেড়ে দিয়েছি, যেমন নোট লিখে রাখা। ছোটখাটো বিষয় মনে রাখার ঝামেলায় যেতে হয়না, ফলে অনেক বড় কিছু  বা গুরত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চিন্তা করার জন্য মস্তিষ্ক সময় এবং সুযোগ পেয়ে যায়। আমাদের মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে চিন্তা করেনা বরং অনেকগুলো চিন্তাভাবনার ভেতর দিয়েই সেটা বিকশিত করে তুলে।" 

এদিকে ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির নিউরোবায়োলোজির অধ্যাপক অলিভার হার্ড বলছেন, " ক্রমাগত স্মৃতির ব্যবহার বন্ধ করে দিলে বরং স্মৃতিশক্তি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। এতে করে প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা আরো বেড়ে যাবে। কেউ যখন ইন্টারনেটে কোনো রেসিপির খোঁজ করে সাথে সাথে তার উপাদান প্রণালীর তালিকাও সেখানে পেয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ সেটা সরাসরি মাথায় গেঁথে না নিয়ে বরং স্মার্টফোনেই সেভ করে রাখে। এটা খুবই সুবিধাজনক, তবে সুবিধারও মুল্য আছে। তারচে ভালো আপনার মস্তিষ্কের যথাযথ ব্যবহার করুন।"

অলিভার হার্ড আরো বলেছেন, " প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন জিপিএস, আমাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে  গ্রে ম্যাটারের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। যা ডিপ্রেশন কিংবা মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেক সময় তা ডিমেনশিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (ডিমেনশিয়া হলো দ্রুত ভুলে যাওয়ার একটি রোগ)। কারণ জিপিএস আমাদের ডানে যেতে বললে ডানে যাই, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। এটা করা খুবই সহজ, মস্তিষ্ককে কোনো পরিশ্রম করতে হয়না। যখন আপনি মস্তিষ্ক দিয়ে চিন্তা করে কোনো স্থানের ম্যাপ চিনতে যাবেন সেটা একটু জটিল লাগবে। আপনি বরং জটিলভাবেই চিন্তা করুন, সেটাই আপনার পক্ষে ভালো এবং সাধারণ জ্ঞানীয় কার্যকরণের উপর প্রভাব ফেলবে।"

শর্ট টার্ম মেমোরি লস

স্মৃতিভ্রংশ ছাড়াও মানব মস্তিষ্কের আরেকটি স্বাভাবিক কার্যক্রম হলো শর্ট টার্ম মেমোরি লস বা স্বল্পস্থিতির স্মৃতি হারানো। নিউরোসায়েন্স অনুযায়ী মানুষের স্মৃতির গঠন হয় তিনটি ধাপে। সেন্সরি, শর্ট টার্ম ও লং টার্ম। খুবই ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি হলো সেন্সরি মেমোরি। শর্ট টার্ম মেমোরি কিছুটা সংরক্ষিত থাকে তবে বেশিরভাগই বিলীন হয়ে যায়। আর লং টার্ম মেমোরি হলো যেটা মানুষ অনেকদিন পর্যন্ত মনে রাখে। যে স্মৃতি ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায় তাকে বলে শর্ট টার্ম মেমোরি লস। যেমন: আমরা যখন কারো ফোন নম্বর শুধুমাত্র দেখি সেটা শর্ট টার্ম মেমোরি হিসেবে থাকে। আর যদি সেই নম্বরটা মুখস্থ করে ফেলি সেটা হয়ে যায় লং টার্ম মেমোরি। তবে নিয়মমাফিক চললে শর্ট টার্ম মেমোরির স্থায়িত্ব বাড়ানো এবং ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব। 

ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়

- স্মার্টফোনের ব্যবহার কমিয়ে দেয়া। রাতে ঘুমানোর সময় স্মার্টফোন সাথে না রাখা এবং নাগালের বাইরে রাখা।
- অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কমিয়ে আনা।
- জিপিএস ডিরেকশন না মেনে বরং নিজেই জিপিএস দেখে লোকেশন খুঁজে নেয়া। 
- সপ্তাহে অন্তত একদিন নিজেকে যেকোনো প্রকার স্মার্ট বা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।
- স্মার্টফোন বহির্ভূত কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া। যেমন বই পড়া, খেলাধুলা, ভ্রমণ ইত্যাদি। 
- ঠিকমতো ঘুমানো। কমপক্ষে ৬ ঘন্টা ঘুম নিশ্চিত করা। নিদ্রাহীনতা থেকে দূরে থাকা।
- নিয়মিত ব্যায়াম ও এক্সারসাইজ করা।
- মেডিটেশন কিংবা প্রার্থনা করা। প্রয়োজনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
- একইসাথে একাধিক কাজ না করে, প্রতিবারে একটি কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করা।
- রুটিনমাফিক জীবনযাপন করা।
- ডিস্ট্রাকশন থেকে দূরে থাকা, অপ্রয়োজনীয় কাজ করা থেকে বিরত থাকা। 
- আসক্তি থেকে দূরে থাকা, সেটা যেকোনো কিছুরই হোক না কেন।

Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.